বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫ - ১৩:১০
যুদ্ধ কি ধর্মীয় বিভাজনকে আরও তীব্র করছে?

যুদ্ধ ধর্মের ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিভাজন তৈরি করে, কিন্তু সচেতন নেতৃত্ব ও মানবিক মূল্যবোধ সেই বিভাজন নিরসনের পথ খুলে দিতে পারে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আসসালামু আলাইকুম।
আখতার সাহেব, আপনাকে আমাদের আলোচনায় স্বাগত জানাই। আমাদের আজকের প্রশ্নটি হলো—"যুদ্ধ কি ধর্মীয় বিভাজনকে আরও তীব্র করে তোলেছে?" এই বিষয়ে আপনার মতামত কি?

হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা আখতার আলি: ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
ধন্যবাদ। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে খুবই প্রাসঙ্গিক। যুদ্ধ কখনোই কেবল ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক সংঘর্ষ নয়, অনেক সময় এটি ধর্মীয় পরিচয়, ইতিহাস এবং বিশ্বাসের উপরও আঘাত হানে। বিশেষ করে যখন একটি যুদ্ধকে ধর্মের ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয় বা ধর্মীয় পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে 'বন্ধু' ও 'শত্রু' নির্ধারণ করা হয়, তখন বিভাজন আরও গভীর হয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আপনি কি বলতে চাচ্ছেন—যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ধর্মকে ব্যবহার করা হয় বিভক্তি সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে?

হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা আখতার আলি: ঠিক তাই। ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে—ক্রুসেড থেকে শুরু করে আধুনিক কালের ইসলামিক স্টেট (ISIS) পর্যন্ত—ধর্মকে যুদ্ধের নৈতিকতা জোগাতে ব্যবহার করা হয়েছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে একদিকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে উম্মাহ চেতনার দোহাই দিয়ে সংঘর্ষকে ধর্মীয় রূপ দেওয়া হয়েছে। এতে দ্বন্দ্বটি কেবল ভূখণ্ডগত নয়, বরং আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের সংকটে পরিণত হয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: এই ধর্মীয় বিভাজনের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে কী প্রভাব পড়ছে?

হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা আখতার আলি: সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে পারস্পরিক সহনশীলতা হারানো। যুদ্ধ-পরবর্তী সমাজে দেখা যায়, এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে অবিশ্বাস করতে শেখে। শরণার্থী, সংখ্যালঘু কিংবা দ্বন্দ্ব অঞ্চলের ধর্মীয় জনগোষ্ঠী অনেক সময় ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘অন্যপক্ষের এজেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এর ফলে শুধু সম্পর্ক নয়, সামাজিক সৌহার্দ্যও ভেঙে পড়ে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ধর্ম তো মূলত শান্তি, সহনশীলতা এবং ন্যায়ের শিক্ষা দেয়। তাহলে যুদ্ধের সময় এই মূল্যবোধগুলো কোথায় হারিয়ে যায়?

হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা আখতার আলি: চমৎকার প্রশ্ন। আসলে ধর্ম নিজে কখনোই সহিংস নয়, তবে ধর্মের ব্যাখ্যা ও ব্যবহার অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিকৃত হয়। নেতারা যখন যুদ্ধকে ধর্মীয় রঙে রাঙান, তখন ধর্মের মানবিক ও শান্তিপূর্ণ দিকগুলো চাপা পড়ে যায়। যুদ্ধকালীন প্রচারণায় এই ব্যাখ্যাগুলো জনগণের মধ্যে ‘আমরা বনাম ওরা’ ধরনের মনোভাব গড়ে তোলে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আপনার মতে, যুদ্ধ কি দীর্ঘমেয়াদে ধর্মীয় সহাবস্থানের ভিত্তিগুলোকে ধ্বংস করে দেয়?

হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা আখতার আলি: যদি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং সাংস্কৃতিকভাবে ধর্মকে শত্রুতা তৈরির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা সহাবস্থানের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ইরাক যুদ্ধের পর শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক অনেকটাই উত্তপ্ত হয়েছে। অনেক দেশেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহানুভূতির জায়গায় স্থান নিয়েছে অবিশ্বাস এবং আতঙ্ক।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে?

হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা আখতার আলি: প্রথমত, ধর্মীয় নেতাদের উচিত—ধর্মকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা এবং যুদ্ধ বা সহিংসতাকে ধর্মের অংশ হিসেবে তুলে ধরা থেকে বিরত থাকা। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থায় সহনশীলতা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ এবং শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা জরুরি। এছাড়াও, মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন বার্তা ছড়ানো দরকার, যা ধর্মকে বিভাজনের নয় বরং সংযোগের উৎস হিসেবে উপস্থাপন করে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: চমৎকার বিশ্লেষণ। আপনি আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরলেন—ধর্ম কীভাবে যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত হয় এবং কীভাবে আমরা সেই বিভাজন কাটিয়ে উঠতে পারি। আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ আখতার সাহেব।

হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা আখতার আলি: আপনাকেও ধন্যবাদ। এমন আলোচনার মাধ্যমেই আমরা কিছু সচেতনতা তৈরি করতে পারি।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মজিদুল ইসলাম শাহ

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha